বোকা তোতাপাখি উন্মোচোন করবে বাংলার সংস্কৃতি , সৌন্দর্য, ইতিহাস , ঐতিহ্য,সুর, সংগীত | বোকা তোতাপাখি উড়ে বেরাবে সারা বাংলায়, তোমার আঙ্গিনাতেও আসবে | তাই কান পাতো আর চোখ খোলা রাখো |
প্রায় চার হাজার বছরের পুরনো তাম্রযুগের ধ্বংসাবশেষ বাংলায় পাওয়া গেছে । ইন্দো-আর্যদের আসার পর অঙ্গ, বঙ্গ এবং মগধ রাজ্য গঠিত হয় খ্রীষ্টপূর্ব দশম শতকে । এই রাজ্যগুলি বাংলা এবং বাংলার আশেপাশে
স্থাপিত হয়েছিল । অঙ্গ বঙ্গ এবং মগধ রাজ্যের বর্ণনা প্রথম পাওয়া যায় অথর্ববেদে প্রায় ১০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে । মৌর্য সাম্রাজ্য মগধেই গড়ে উঠেছিল । এই সাম্রাজ্য অশোকের রাজত্বকালে দক্ষিণ এশিয়া, পারস্য,
আফগানিস্তান অবধি বিস্তার লাভ করেছিল । পরবর্তীকালে শক্তিশালী গুপ্ত সাম্রাজ্য মগধেই গড়ে ওঠে যা ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরাংশে এবং পারস্য এবং আফগানিস্তানের কিছু অংশে বিস্তার লাভ করেছিল ।
৩০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই অঞ্চলে পর্যায়ক্রমে মৌর্য রাজবংশ, গুপ্ত রাজবংশ, পাল রাজবংশ, সেন রাজবংশ এবং মুসলিমদের আগমন ঘটেছে। এই অঞ্চলের মানুষ এদের জীবনযাত্রা এবং সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।
এরপর পর্তুগাল, ফ্রান্স, এবং ব্রিটিশদের জাহাজ এদেশের বন্দর এ নোঙর ফেলেছে। এরা পণ্যের পাশাপাশি সংস্কৃতিও এদেশে রেখে গেছে। প্রতিটি জাতি শুধু শারীরিকভাবে নয়, সংস্কৃতিরও সহায়তায় এদেশে নিজেদের
ছাপ রেখে গেছে এবং এভাবেই এদেশের সংস্কৃতির ভিত রচিত হয়েছে।
পল্লীর জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ লোক সাহিত্যে অবদান রেখেছেন। এদের একটি বড় অংশ লোক-কবি যাদের সাধারণত বয়াতি বলা হয়ে থাকে। প্রাচীন রাশিয়ার BAYAT শব্দ থেকে বয়াতি শব্দের উৎপত্তি।বাংলার
মাঝিরা নৌকায় পাল তুলে মনের সুখে ভাটিয়ালি গান গায়। দেশের উত্তরাঞ্চলের গাড়োয়ান বা গরুর গারির চালক গাড়ি চালাতে চালাতে ভাওয়াইয়া গানের সুর তুলে। বাউলেরা একতারা বাজিয়ে তাঁদের তত্ত্ব তুলে ধরেন।
বাংলাদেশের লোক সাহিত্য বাংলা সাহিত্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। যদিও এর সৃষ্টি ঘটেছে অশিক্ষিত জনগোষ্ঠির মাধ্যমে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রসার ঘটেছে মৌখিকভাবে, তথাপি বাংলা
সাহিত্যকে এ লোক সাহিত্য ব্যাপ্তি প্রদান করেছে, করেছে সমৃদ্ধ। পৃথক পৃথক ব্যক্তি-বিশেষের সৃষ্টি পরিণত হয়েছে জনগোষ্ঠির ঐতিহ্যে যার মাধ্যমে প্রকাশ ঘটেছে ভালোবাসা, আবেগ, অনুভূতি ও চিন্তা চেতনার।
বাংলা সংগীত বাংলার সহস্রাব্দ প্রাচীন ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ সাংগীতিক ঐতিহ্যটিকে নির্দেশ করে। ঐতিহাসিক বাংলা অঞ্চলটি বর্তমানে ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বিভক্ত। বাংলা ভাষায় রচিত ও
বিভিন্ন শৈলীর সুরে সমৃদ্ধ বাংলা সংগীতধারাটি এই উভয় অঞ্চলেই ব্যাপক জনপ্রিয়তার অধিকারী।
লোকগীতি
বাংলাদেশের সংগীত মূলত কাব্যধর্মী। এদেশীয় সংগীতে বাদ্যযন্ত্রের চেয়ে মৌখিক সুরের দক্ষতার উপর অধিক নির্ভরশীলতা লক্ষ করা যায়। লোকগীতিকে আমরা সাতটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করতে পারি। এগুলো হচ্ছেঃ
প্রেম, ধর্মীয় বিষয়, দর্শন ও ভক্তি, কর্ম ও পরিশ্রম, পেশা ও জীবিকা, ব্যাঙ্গ ও কৌতুক এবং এসবের মিশ্রণ। অন্যদিকে এদেশীয় লোকসাহিত্যে আমরা গানের বিভিন্ন শাখা দেখতে পাই। এগুলো হচ্ছেঃ বাউল গান,
ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, গম্ভীরা, কবিগান, জারিগান, সারিগান, ঘাটু গান,যাত্রা গান ,ঝুমুর গান, জাগের গান প্রভৃতি।
# বাউল গান
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় বাউল নামে এক অধ্যাত্মবাদী চারণকবি সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে। মনে করা হয়, তান্ত্রিক কর্তাভজা সম্প্রদায় ও ইসলামি সুফি দর্শনের ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল এঁদের গানে।
কুষ্টিয়ার লালন ফকিরকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাউল মনে করা হয়। তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব ছিলেন।ইতিহাসবিদদের মতে, সতেরো শতকে বাংলাদেশে বাউল মতের উদ্ভব হয়। এ মতের প্রবর্তক হলেন আউল চাঁদ
ও মাধববিবি। বীরভদ্র নামে এক বৈষ্ণব মহাজন সেই সময়ে একে জনপ্রিয় করে তোলেন। লালন সাঁইয়ের গানের মধ্য দিয়ে বাউল ব্যাপক পরিচতি লাভ করে। ২০০৫ সালে ইউনেস্কো বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান
ঐতিহ্যসমূহের মাঝে বাউল গানকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষনা করে। বাউল সঙ্গীতের আরও দুই বিশিষ্ট নাম হলেন মধ্যযুগের হাসন রাজা ও আধুনিক যুগের বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম।
# সিলেটের মরমী সাহিত্য
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন লোকঐতিহ্যের অনবদ্য ফসল মরমী সঙ্গীত বা মরমীবাদের গান। উল্লেখ্য যে, মরমী সঙ্গীত ও বাউল গানকে অধুনা যুগে যদিও এক করে ভাব হয়, কিন্তু এর ইতিহাস সন্ধানি সৈয়দ মোস্তফা
কামাল ও অন্যান্যদের কাছে এর ভাবধারায় ভিন্নতা রয়েছে বলে অভিমত পাওয়া যায়।
# বিষ্ণুপুর ঘরানা
বিষ্ণুপুর ঘরানা হল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের হিন্দুস্তানী ধারার দ্রুপদ সংগীতের একটি ঘরানা। দিল্লির বাহাদুর খান, যিনি তানসেনের একজন উত্তরসূরী ছিলেন, তিনি এ বিষ্ণুপুর সংগীতের প্রবক্তা।
# ভাওয়াইয়া।
ভাওয়াইয়া গানের আকরভূমি রংপুর। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের নদী-নালা কম থাকায় গরুর গাড়িতে চলাচলের প্রচলন ছিল। আর গরুর গাড়ির গাড়োয়ান রাত্রে গাড়ি চলাবস্থায় বিরহ ভাবাবেগে কাতর হয়ে আপন মনে
গান ধরে। উঁচু-নিচু রাস্তায় গাড়ির চাকা পড়লে তার গানের সুরে আধো-ভাঙ্গা বা ভাঁজ পড়ে। এই রকম সুরে ভাঙ্গা বা ভাঁজ পড়া গীতরীতিই 'ভাওয়াইয়া' গানে লক্ষণীয়। এসকল গানে স্থানীয় সংস্কৃতি, জনপদের
জীবনযাত্রা, তাদের কর্মক্ষেত্র, পারিবারিক ঘটনাবলী ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয়।
# ভাটিয়ালি।
ভাটিয়ালী বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের জনপ্রিয় লোকগীতি। ভাটিয়ালী গানের মূল বৈশিষ্টা হলো এ গানগুলো রচিত হয় মূলত মাঝি, নৌকা, দাড়, গুন ইত্যাদি বিষয়ে।
# গম্ভীরা।
বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ও পশ্চিমবঙ্গের মালদহ অঞ্চলে গম্ভীরার প্রচলন রয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা অঞ্চলের গম্ভীরার মুখ্য চরিত্রে নানা-নাতি খুব জনপ্রিয়। শিবের উৎসবে শিবের বন্দনা করে যে গান
গাওয়া হত- সেই গানের নামই কালক্রমে হয়ে যায়‘গম্ভীরা’।
# কবিগান
কবিগান বাংলা লোকসংগীতের একটি বিশেষ ধারা। এই ধারায় লোককবিরা প্রতিযোগিতামূলক গানের আসরে অংশগ্রহণ করে থাকেন।
# জারিগান
বাংলাদেশে মহররমের বিশেষ দিনে কারবালার শোকাবহ ঘটনা অবলম্বনে নৃত্যগীত সহকারে যে কাহিনী পরিবেশিত হয় তা সাধারণভাবে জারিগান বলে পরিচিত। ১৭শ শতক থেকে বাংলায় এই গানের ধারা প্রচলিত।
# মৈমনসিংহ গীতিকা
ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রচলিত পালাগানগুলোকে একত্রে মৈমনসিংহ গীতিকা বলা হয়।
# পূর্ববঙ্গ-গীতিকা
পূর্ববঙ্গ অঞ্চলের প্রচলিত লোকসাহিত্যকে একত্রে পূর্ববঙ্গ গীতিকা বলা হয়।
# সিলেট গীতিকা
সিলেটের লোকমানুষের রচিত মৌখিক কেচ্ছা, কাহিনী, যাত্রা-পালা ইত্যাদি লোকভাণ্ডারকে এক সাথে সিলেট গীতিকা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
# রবীন্দ্রসঙ্গীত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারা জীবনে ২,২৩০টি গান রচনা করেছিলেন। ভক্তি, প্রেম, প্রকৃতি, দেশাত্মবোধ ইত্যাদি নানা বিষয়কেন্দ্রিক এই গানগুলিই রবীন্দ্রসঙ্গীত বা রবীন্দ্রগান নামে পরিচিত।
# নজরুলগীতি
বাংলা সঙ্গীতের আর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারা হল বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সৃষ্ট নজরুলগীতি বা নজরুলসংগীত।
রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল ছাড়াও রামনিধি গুপ্ত (নিধুবাবু), অতুলপ্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেনের গানও দুই বাংলায় সমান জনপ্রিয়।
১৮৬৭ সালে আয়োজিত হিন্দুমেলা বা স্বদেশী মেলায় দেশাত্মবোধক গানের ধারণাটির উদ্ভব হয়।
# আধুনিক গান
বাংলা আধুনিক গানের ধারাটিও যথেষ্ট সমৃদ্ধ।
# বাংলা ব্যান্ড
১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশের আজম খানের ব্যান্ড উচ্চারণ এবং আখন্দ (লাকী আখন্দ ও হ্যাপী আখন্দ) ভাতৃদ্বয় দেশব্যাপী সঙ্গীতের জগতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
মহীনের ঘোড়াগুলি পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের বাংলা ব্যান্ড সংগীতে প্রথম ব্যান্ড বলে স্বীকৃত।
পরবর্তীকালে ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশক থেকে পাশ্চাত্য ধ্যানধারণা ও আধুনিক নগরজীবনকেন্দ্রিক বাংলা ব্যান্ড সংগীত ও জীবনমুখী গানের উদ্ভব হয় কলকাতা ও ঢাকা শহরে।